Saturday, August 28, 2010

পার্বত্য ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি ও ভূমিকমিশন চেয়ারম্যানের ব্যবস্থাপত্র

সংবিধান সংশোধন ও আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবীটি এখন সবচেয়ে আলোচিত হয়ে দাঁড়িয়ছে।ঠিক সেই মুহুর্তে দৈনিক ‘প্রথম আলো’গত ২৫ আগস্ট “পার্বত্য ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি আইনে ছয়টি ধারা সংশোধন ও বিরোধহীনভূমি জরিপ হবে” মর্মে একটি সংবাদ ছাপিয়েছে।আজকে ২৮ আগস্ট যখন এ লেখাটি তৈরী করছিলাম, তখন ‘প্রথম আলো’তে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি বিষয়ে একটি সম্পাদকীয় চোখে পড়ল।এতে বিরোধহীনভূমিতে জরিপ করলে সমস্যা থাকার কথা নয় উল্লেখ করে বিষয়টিতে আদিবাসী নেতাদের সমর্থন জানানো উচিত এবং সব আশংকা দূরীকরণের জন্যে প্রশাসনের তরফে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মন্তব্য করা হয়েছে।জানিনা, উল্লেখিত সংবাদ ও ‘প্রথম আলো’র সম্পাদকীয়টি আমাদের পার্বত্য নেতারা কিভাবে আমলে নিচ্ছেন।তবে গত ২৫ আগস্টে প্রকাশিত সংবাদে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক রয়েছে।সেগুলো আলোচনার দাবী রাখে। যেমন,

(১)সংবাদে বলা হয়েছে, পুরোনো আইনে বন্দোবস্ত, বিরোধনিষ্পত্তি, পুনর্বাসিত শরণার্থী, দখল-বেদখল ও আবেদনের পদ্ধতি নিয়ে যে অসংগতি রয়েছে তা দূর করার জন্যে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের ছয়টি ধারা সংশোধনের জন্যে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে।

(২)ভূমি সচিবের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, পার্বত্য এলাকার যেসব ভূমি নিয়ে কোন সমস্যা নেই, সেই অংশে সরকার জরিপের উদ্যোগ নিচ্ছে।তবে এ ব্যাপারে পার্বত্য নেতাদের মতামত নেওয়া হবে বলে জানান।

(৩) পার্বত্য চুক্তিতে ভূমিবিরোধ নিষ্পতির পরে ভূমিজরিপের কথা স্পষ্টভাবে বলা হলেও ভূমিকমিশন চেয়ারম্যান বিচারপতি (অবঃ) খাদেমূল ইসলাম চৌধুরী আবারও জোর দিয়ে বললেন, “আগে জরিপ করতে হবে,তারপর ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি। জরিপ কার্যক্রম শুরু না হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি,স্থিতিশীলতা, সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকারের সব উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যাবে”।

Justice (retd) Khademul Islam Chowdhury, Chairman, CHT Land Commission, and Mr. Jatindra Lal Tripura, MP and Chairman, Task Force on Rehabilitation of Refugees and IDPs.
এ লেখায় ১ নং বিষয়ে বিস্তারিতভাবে বলার প্রয়োজন নেই।কেননা,ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের আইনে বিসমিল্লায় গলদ ছিল,সে কারণে এ কমিশন দীর্ঘ একযুগ সময়েও কোন কাজ করতে পারেনি।অন্যদিকে বারবার সরকার পরিবর্তন হলেও এ যাবত কোন সরকারই আইন সংশোধনে কোন কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি।যদি আওয়ামী নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার পার্বত্যচুক্তির মূল চেতনার সাথে সংগতি রেখে ‘ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের আইন’ সংশোধন করে এবং সেভাবে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাহলে সাধুবাদ জানাতে হবে।তবে শেষটা না দেখা পর্যন্ত এখনও আশান্বিত হওয়ার কোন কারণ নেই।

এদিকে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনে সংশোধন হোক আর নাই হোক উপরে উল্লেখিত ২ নং ও ৩ নং বিষয়ে কিছু আশংকা রয়েছে সেগুলো একটু আলোচনা করা প্রয়োজন।উক্ত দু’টো বিষয়ই ভূমি জরিপ সংক্রান্ত।গত বছর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ভূমিকমিশন চেয়ারম্যান খাদেমুল সাহেব একটি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন, ‘কোনটা আগে - ভূমি জরিপ নাকি বিরোধ নিষ্পত্তি? এ প্রশ্নের সাথে সরকার আরো একটি প্রশ্নের জন্ম দিতে যাচ্ছে,‘ভূমি জরিপ কোথায় থেকে শুরু হবে?বিরোধহীন ভূমি থেকে নাকি বিরোধপূর্ণ ভূমি থেকে?

আইনি কিতাবে যাই লেখা থাকুক, খাদেমুল সাহেব তো আগেই একটা ব্যবস্থাপত্র দিয়ে রেখেছেন, আগে ভূমি জরিপ করতে হবে।তারপর ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি হবে। এবার এ কথার সাথে আরো একটি ভয়ংকর কথা যোগ করলেন, “জরিপ কার্যক্রম শুরু না হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি, স্থিতিশীলতা, সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকারের সব উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যাবে”। ভূমি জরিপ তো পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক যুগ ধরে হয় নি; তাহলে কী ধরে নেবো খাদেমুল ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান হওয়ার আগ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে গৃহীত সব সরকারী উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছিল? ‘ভূমি জরিপ’ না হলে ‘সরকারের সব উদ্যোগ ব্যর্থ হবে’-খাদেমুলের এ বক্তব্য পড়ে ভাবছিলাম তিনি কিভাবে পার্বত্য ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি ‘ব্যবস্থাপত্রে’ নতুন নতুন ‘অনুপান’ জুরে দিচ্ছেন।মনে পড়ল,মারমা ভাষার প্রবাদ বাক্যটা “ল্যূমা ল্যূ হিরে চিগা মা চিগা হিরে”(মানুষের মধ্যে মানুষ আছে কথার মধ্যে কথা আছে)(মারমা ভাইবোনেরা ভুল হলে শুদ্ধ করে দেবেন)।প্রশ্ন জাগে মনে, সরকার ও খাদেমুলের আপাত: নিদোর্ষ ‘কথা’গুলোর মধ্যে কী ‘কথা’ আছে, আর ভূমি কমিশন চেয়ারম্যান ‘খাদেমুলে’র মধ্যে কোন ‘খাদেমুল’ আছে? বিশ্লেষণ করে দেখা যাক ভূমি জরিপের “ল্যূমা ল্যূ হিরে চিগা মা চিগা হিরে” কথাটা।

মনে হচ্ছে, সরকার একটু চালাকি করে এগোতে চায়। ভূমি জরিপ ‘আগে’ হবে বা ‘পরে’ হবে সেরকম কিছু না বলে সরকার এখন বলছে পার্বত্য নেতাদের মতামত নিয়ে ‘বিরোধহীনভূমি’ জরিপ হবে।পার্বত্য নেতারা কী মতামত দেবেন জানিনা। কিন্তু আমার মনে অনেক প্রশ্ন জাগে,বিরোধহীনভূমিতে কেন আগে জরিপ শুরু করা প্রয়োজন? বিরোধহীনভূমিতে জরিপ করার উদ্দেশ্য কী? কোনগুলোই বা বিরোধহীনভূমি? সরকারের “বিরোধহীনভূমিতে জরিপ” কিংবা খাদেমুলের “আগে ভূমি জরিপ করতে হবে” এরকম কথার মধ্যে আরো কিছু কথা আছে বলে মনে হয়। সেগুলো হলোঃ

১. খাদেমুলের মত “ভূমি জরিপ আগে হতে হবে” এরকম কিছু না বললেও সরকার পরোক্ষভাবে খাদেমুলের ব্যবস্থাপত্র অনুসরণ করতে চাচ্ছে।সরকার হয়তো মনে করছে যে কোন ভাবে জরিপ শুরু করা গেলে সেটা যে কোন প্রকারে শেষ করা যাবে।প্রয়োজনে সেনা-পুলিশ-বর্ডার গার্ড নিয়োগ করে হলেও সেটা শেষ করা যাবে।

২. ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে জরিপের কথা বলা হলেও সরকারের বা খাদেমুলের উদ্দেশ্য অত্যন্ত আন্তরিক ও সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একথা বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। সেরকম বাস্তব প্রমাণ তাদের কাছ থেকে এখনো পাওয়া যায়নি।‘বিরোধহীনভূমি’ বলতে কী বুঝায় সেটা পরিস্কার না করে ভূমি জরিপ শুরু করার চেষ্টাটা একটি কুটচাল ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।

৩. ‘বিরোধহীন ভূমি’তে জরিপ করার অনুমোদন দেওয়ার অর্থ হলো বিরোধ নিষ্পত্তির আগে জরিপ করতে দেওয়া।অন্যদিকে বিরোধ নিষ্পত্তির আগে ভূমি জরিপ করার পেছনে সরকার বা খাদেমুলের কয়েকটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে। যেমন, ক) জরিপের মাধ্যমে কোথায় কোথায় কী কী ধরনের, কী পরিমাণের জমি আছে, সরকারী ভাষায় কোথায় কোথায় খাসজমি আছে, কোথায় কোথায় পাহাড়, বন ও নদীনালা আছে, কোথায় কোথায় কী পরিমাণ বন্দোস্তকৃত ও অবন্দোস্তকৃত জমি আছে সেগুলো চিহ্নিত করা যাবে;খ) জরিপের মাধ্যমে সব ভূমি চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যের পেছনে একটি অন্তর্নিহিত বার্তা আছে। সেটা হলো ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তির বিচারকালে যদি কোন সেটেলার অবৈধ দখলদার হিসেবে প্রমাণিত হয়, তাহলে তাকে ব্যক্তিমালিকানা বহির্ভূত সরকারী জমি অর্থাৎ খাসজমিতে বসতি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে ভূমি কমিশন (অর্থাৎ খাদেমুল) আগেভাগে প্রস্তুত। এ যুক্তির পেছনে গত ফেব্রুয়ারীতে বাঘাইছড়িতে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়।যতদূর জানি,বছর তিনেক আগে সেনাক্যাম্পে কাজ করার জন্যে শ্রমিক প্রয়োজন এমন অজুহাতে সেনাবাহিনীরা কিছু সেটেলার পরিবার সেখানে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু সেখানকার পাহাড়ীরা সেটা চায়নি, এবং প্রতিবাদ করেছিল।প্রতিবাদের মুখে সেনাবাহিনী তখন তা করতে না পারলেও বছর খানেক পরে কিছু সেটেলার পরিবার নিয়ে গিয়েছিল।তখন সেনাবাহিনী যুক্তি দিয়েছিল,“বাঙালিরা (সেটেলাররা) সরকারী (বনবিভাগের) জমিতে ঘর তুলেছে, পাহাড়ীদের জমিতে নয়”।পাহাড়ীদেরকে বাড়াবাড়ি না করার জন্যে তারা হুমকি দিয়েছিল।অবশেষে ২০১০-এর ফেব্রুয়ারীতে তা পাহাড়ী-বাঙালি দ্বন্দে রূপ নেয়।

৪. বাঘাইহাটের ঐ ঘটনার সাথে সাযুজ্য রেখে বলা যায়, ভূমি কমিশনের খাদেমুলের ভেতরে ‘সেনাবাহিনীর চেতনাসম্পন্ন খাদেমুল’ রয়েছে। প্রকাশ্যভাবে না বললেও বিচারপ্রক্রিয়ায় অবৈধ দখলদার হিসেবে প্রমাণিত সেটেলারদেরকে তথাকথিত সরকারী ‘খাস’জমিতে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার চিন্তা তার মনের মধ্যে রয়েছে। ঠিক বাঘাইছড়ির সেনাবাহিনীর মত সরকার তথা খাদেমুলও পরে হয়ত বলবেন,“পাহাড়ীদের ভূমিতে নয়,সরকারী খাসজমিতে বাঙালিদের (সেটেলারদের)বসতি দেওয়া হবে”।খাদেমুল সাহেব সেটা আইনগতভাবে পাকাপোক্ত করার সুযোগ নিতে চাচ্ছেন ।এ ধরনের উদ্যোগকে অনেকে ‘পাহাড়ী-বাঙালির সহাবস্থানে’র নীতি হিসেবে বলে থাকেন।এরকম ‘সহাবস্থানের নীতি’বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সরকার তথা খাদেমুল ভূমি জরিপকে বিরোধ নিষ্পত্তির পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচনা করছেন।

৫. ভূমি জরিপের অর্থ হলো পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামকে কাগজের টুকরো দিয়ে ব্যক্তিগত সম্পক্তিতে পরিণত করা, এবং ভাগবাটোয়ারার ব্যবস্থা করা।একবার জরিপ হয়ে গেলে পাহাড় আর পাহাড় থাকবে না, জঙ্গল আর জঙ্গল থাকবে না।আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমি বলে আর কিছুই থাকবে না। জমি চুরি, ও ভাগবাটোয়ারার লড়াই শুরু হবে। সেই লড়াইয়ে নিরীহ জুমচাষী কিংবা সেটেলাররা জমি ভাগ পাবে কি না বড় সন্দেহ রয়েছে।সেই লড়াইয়ে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অবঃ) আব্দুল মতিন ও সাংসদ অলি আহম্মদদের মত রাঘাব বোয়াল ও জেনারেলরা, সাধারণের মধ্যে অসাধারণরা ক্ষমতার জোরে ও কলমের খোঁচায় সাধারণ মানুষের প্রথাগত ভূমি কেড়ে নেবে, কখনো বা চুপিসারে চুরি করবে একথা নিশ্চিত করে বলা যায়।ক্ষমতাবানদের ভূমি দখলের অবাধ প্রতিযোগিতা শুরু হবে। তাদেরকে তখন কেউই প্রতিরোধ করতে পারবে না।

ভূমি জরিপের ঘোমটার ভেতর এসব খেমটা নাচের কথা অবশ্যই বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন।তা না হলে ভূমি জরিপের মাধ্যমে আরো নতুন নতুন সংকট সৃষ্টি করা হবে।তাই এ মুহুর্তে ব্যাপক আকারের ভূমি জরিপ, সেটা বিরোধহীন ভূমিতে হোক আর বিরোধপূর্ণ ভূমিতে হোক- কোনভাবে কাম্য হতে পারে না।

এবার ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান খাদেমুলের ব্যবস্থাপত্রের নতুন ‘অনুপান’ (জরিপ কার্যক্রম শুরু না হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি, স্থিতিশীলতা, সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকারের সব উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যাবে)-এর দিকে একটু দৃষ্টি দেয়া যাক।খাদেমুলের এ ‘অনুপান’টা পার্বত্য চট্টগ্রাম রোগের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়।তিনি যা বলেছেন তা কোন গবেষণালব্দ তত্ত্ব নয়,তার ভাববিলাসী মনের কল্পনা মাত্র।পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি, স্থিতিশীলতা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে কেবল একটিমাত্র দিক ‘ভূমি জরিপে’র সাথে সংশ্লিষ্ট করেছেন,যা একদেশদর্শীতায় দুষ্ট।তাই খাদেমূলের ব্যবস্থাপত্র বেশি বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই।তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি, স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে, ব্যরিস্টার রাজা দেবাশীষ রায়ের ভাষায় বলতে হয়, খাদেমূলকে আমিন-কানুনগো’র কাজ করার চিন্তা বাদ দিতে হবে এবং সৃজনশীল কাজের কথা ভাবতে হবে।খাদেমুল সাহেবকে তার ব্যবস্থাপত্রে আরো কিছু ‘অনুপান’ বিবেচনায় নিতে হবে, তা না হলে তিনি ‘পার্বত্য ভূমিরোগ’ সারানোর ব্যাপারে কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারবেন না।

১। পার্বত্য চট্টগ্রামের নেতৃবৃন্দ ভূমিজরিপের বিপক্ষে নন; তবে তারা খাদেমুলকে চুক্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার কথা বলছেন। চুক্তিতে স্পষ্ট বলা আছে,কখন ভূমি জরিপ হবে।অর্থাৎ মাঠে ময়দানে উত্তেজক বক্তব্য না রেখে ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে খাদেমুলকে ভূমি কমিশনের সব সদস্যের সাথে বসে ঐক্যমতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কমিশন কী কী কাজ করবে।

২। ভূমিকমিশনের আইনে বিসমিল্লায় যে গলদ হয়েছে সেটা সংশোধনের উদ্যোগ নিতে হবে। কমিশন চেয়ারম্যানের একক কর্তৃত্বের মধ্যে ভারসাম্য নিয়ে আসতে হবে।

৩। ভূমি জরিপ নয়, কমিশনের প্রথম কাজ হওয়া উচিত কোথায় কোথায় বিরোধ আছে সেগুলো চিহ্নিত করা।এরপর ভূমি কমিশন আইন অনুসরণে সেগুলো মীমাংসার জন্যে কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ করা।এক্ষেত্রে এক একটি কেস ধরে ভূমি কমিশন শুনানী করতে পারে।সেটা মীমাংসা করতে গিয়ে যদি কোন জরিপের প্রয়োজন হয়, তৎক্ষণাৎ বিরোধপূর্ণ ভূমিতে জরিপ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে জেলা/উপজেলা ভূমি অফিস সহযোগিতা দিতে পারে।এর জন্যে ঢাকঢোল বাজিয়ে সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপ শুরু করার প্রয়োজন পড়ে না।

৪।ন্যায়বিচার ও ক্ষতিপূরণের বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। যেসব সেটেলার পরিবার অবৈধ দখলদার বলে বিবেচিত হবে তাদেরকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।কিভাবে পুনর্বাসন হবে সে ব্যাপারে পুরো ভূমিকমিশন ও সরকারকে ঐক্যমত্যে পৌঁছতে হবে।খাদেমুলের একতরফা ‘সহাবস্থানের নীতিতে’ পুনর্বাসনের চেষ্টা করা হলে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না।

৫। শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকায়ন বন্ধ করতে হবে।অপ্রিয় হলেও সত্য, সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গীবাদী শক্তির মদদ দাতা হলো সেনাপ্রশাসনের একাংশ। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনতে হলে সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে এবং গণতান্ত্রিক প্রশাসনের কাছে কর্তৃত্ব হস্তান্তর করে বেসামরিক প্রশাসনকে শক্তিশালী করতে হবে।

৬। আইনশৃংখলা রক্ষা ও উন্নয়নের জন্যে চুক্তি মোতাবেক মিশ্র পুলিশবাহিনী গঠন করতে হবে। জনশৃংখলা রক্ষা ও নিরাপত্তা বিধানের এ দিকটি উপেক্ষিত থাকলে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা তথা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হবে।

আরো অনেক সুপারিশ রাখা যায়। তবে খাদেমুলকে মনে রাখতে হবে শান্তিপ্রতিষ্ঠার প্রথম ও প্রাথমিক পূর্বশর্ত হলো পারস্পরিক আস্থা, শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের পরিবেশ গড়ে তোলা।কিন্তু তিনি কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োজিত হওয়ার পর থেকেই কমিশনের অন্যান্য সদস্যদের কোন তোয়াক্কা না করে একটার পর একটা বিতর্কিত কথা বার্তা বলে বেড়াচ্ছেন।ভূমি জরিপ না হওয়ার কারণে নয়,তার নিজের একগুঁয়েমী ও একদেশদর্শী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হতে পারে।আরো একটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়, খাদেমুলের নির্দেশিত ব্যবস্থাপত্র পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী সংস্কৃতির সাথে সংগতিপূর্ণ নয়।ভূমি জরিপ করা হলে আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমি হতে বিতারণের আরো এক নতুন যুগ সূচিত হবে।দুঃখ হবে চিরস্থায়ী। বিচারপতি (অবঃ) গোলাম রাব্বানীর ভাষায়, “সমতলভূমিতে মাঠ জরিপ শেষে ইংরেজ আমলে তৈরি রেকর্ডের মতো ভূমি কমিশন কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামে তেমন রেকর্ড করা ন্যায়ত কিংবা আইনত অসিদ্ধ এবং তেমন করার উদ্যোগ নিলে আদিবাসীদের দুঃখ-যাতনা স্থায়ী হয়ে যাবে” (কালের কন্ঠ, ১৬ আগস্ট) ।

তাই আদিবাসী নেতাদের উচিত হবে সরকার তথা খাদেমুলের ব্যবস্থাপত্র ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করা। খাদেমুলের সাথে কাজ করতে না পারলে তাকে ‘বাই বাই’ বলা উচিত।

No comments:

Post a Comment

Cashew nuts, a promising cash crop in the hill tracts of Bangladesh*

During the Covid-19 pandemic, all schools, colleges and other educational institutions including offices were closed down across the who...